০৪:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

তাপদাহ – প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

চলছে গ্রীষ্মকাল। লক্ষণীয় যে, গত কয়েক বছর ধরে এ সময়ে তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলে। কিন্তু কেন বেড়ে চলে? আসুন একটুু হিসেব মেলানোর চেষ্টা করি।

নদীমাতৃক বাংলার দখিন জনপদে পটুয়াখালীর পায়রা নদীর তীরে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগেও এ জনপদে এতো পাকা সড়ক, দালানকোঠা কিংবা সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা গড়ে ওঠেনি। সড়কের দু’ধারে, অনাবাদী জমিতে প্রচুর গাছপালা ছিলো। সমুদ্র উপকূল এবং সুন্দরবন নিকটবর্তী হওয়ায় এ অঞ্চলকে ঘিরে ছিলো গভীর বনাঞ্চল, ছিলো অসংখ্য খাল-বিল, নদী-নালায় ভরপুর একটি জনপদ। ১৯৮০ সালে গঠিত হলো দুমকি উপজেলা। তখনও বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে পনেরো কিলোমিটার দূরে দুমকিতে গিয়ে কাজকর্ম সেরে আবার পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। তখনও দুমকিতে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়নি। তখনকার চীফ কেবিনেট সেক্রেটারী জনাব এম কেরামত আলী সাহেবের চেষ্টায় একটি কৃষি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কলেজটির ছাত্রাবাস ছিলো মাটির মেঝের উপরে গোল পাতার ছাউনীযুক্ত লম্বাকৃতির কাঁচা ঘর। তখনও আশে পাশে ২০/২৫ কিলোমিটারের মধ্যে আমাদের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিলো নৌকা অথবা পায়ে হাঁটা পথ। পটুয়াখালী জেলার যেদিকে তাকাতাম তখন দৃষ্টিনন্দন নদী, সবুজ অরণ্যে আর খাল-বিলে ভরা প্রকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি সমৃদ্ধশালী অঞ্চল।

প্রকৃতির সেই সৌন্দর্য হরণ এবং তদস্থলে ইট পাথরের নতুন নতুন স্থাপনার কাজটি তখন থেকেই শুরু হয়, ব্যাপকভাবে ঠিক আশির দশক থেকেই। যা, দ্রুত তরান্বিত হতে থাকে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দেশে নতুন গণতন্ত্রের আমলে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে নদীর পাড় দিয়ে বেড়িবাঁধ দিয়ে বিছিন্ন করা হয় নদী ও স্থলভাগকে, আটকে ফেলা হয় পানি চলাচলের সমস্ত খাল, ছোট ছোট শাখা নদী। উন্নয়নের নামে দেদারছে নিধন করা শুরু হয় সবুজ অরন্য, নদী ও খাল তীরবর্তী ম্যানগ্রোভ বৃক্ষরাজি। ধীরে ধীরে মরে যায় খাল, বিল, ডোবা নালা সব। নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে মেরে ফেলা হয় তার সদা চঞ্চল স্রোতধারা।

“এখানে রমণীগুলো নদীর মতো, নদীও নারীর মতো কথা কয়” আমাদের চোখের সামনে দেখতে দেখতে অপার সৌন্দর্যে ভরপুর লোহালিয়া, লাউকাঠি, কচাবুনিয়া, পাঙ্গাশিয়া নদীগুলো হারিয়ে ফেলে তাদের কুলকুল ধ্বনির সদা চঞ্চল স্রোতের বেগ। এখন নামে মাত্র ক্ষীণ স্রোতধারা লয়ে কোনমতে টিকে আছে এসব নদীগুলো। আরও দখিনে গেলে গলাচিপা’র ঐতিহাসিক নদী যেমন আগুনমুখা, রামনাবাদ, দাঁড়ছিঁড়া,কাজল, সবগুলো নদী ধীরে ধীরে যৌবন হারাতে থাকে। বিশাল বিশাল চর জেগে উঠেছে সেসব নদীবক্ষে। কলাপাড়ার আন্ধারমানিক, সোনাতলা, শিব বাড়িয়া নদী, আড়পাংগাশিয়া নদী, কচুপাত্রা ও ধানখালী এখন পুরোদস্তুর নাব্যসঙ্কটে ভুগছে।

পটুয়াখালীর প্রমত্তা পায়রা বর্ষাকালে তার দু’পাড়ের হাজার হাজার ঘরবাড়ি ফসলের ক্ষেত ভাসিয়ে দিতো। আবার শরৎ হেমন্তে যার রূপ মাধুর্যে আমরা বিস্মিত, বিমোহিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকতাম তাকে এখন উত্তর বঙ্গের হাওড়ের জলরাশির মতোই মনে হয়।

দেশে চলছে এক সপ্তাহের হিট অ্যালার্ট। অতিরিক্ত তাপদাহে গত তিনদিনে সারা দেশে অন্তত জনা সাতেক লোক মারা গেছেন। ক্রমেই বেড়ে চলেছে এই তাপদহন। দেশের গুটিকয়েক মানুষ যারা এসির মধ্যে বসে আছেন তারা হয়তো আমাদের মতো আম পাব্লিকের কষ্ট কোনমতেই বুঝবেন বলে মনে হয়না। তারা মানবেন কীনা জানিনা যে, তাদের দ্বারা অপরিকল্পিত নগরায়ন, যত্র তত্র অকার্যকর স্লুইস, কালভার্ট আর গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠা করা শত শত ইটের ভাটার কারণে মরু অঞ্চলে পরিণত হতে যাচ্ছে আমাদের সুজলা সুফলা সোনার বাংলা।

এতোক্ষণ বলেছি দখিনের কথা আর উত্তরের খবরতো দেশবাসীর কাছে আরও পরিস্কার। উজানের নদীগুলোর উপরে ভারতের একচেটিয়া দখল থাকার কারনে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে উল্লেখ করা বাহুল্যই বটে।

মনুষ্য সৃষ্ট এইসব কর্মযজ্ঞের কারনে দেশজুড়ে আজ দেখা দিয়েছে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা প্রভৃতি দুর্যোগ। গ্রামে গঞ্জে এখন আর দেশীয় মাছ নেই।
আম, জাম, তাল, নাড়িকেল, খেজুর গাছগুলো এখন অনেকটাই নিষ্ফলা। শহর গ্রামের টিউবওয়েলে পানির লেয়ার অনেক নিচে নেমে গেছে।

গত কয়েকবছর ধরে বলে আসছি, কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হোক, দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ইতিহাস হয়ে যাওয়া খাল আর শাখা নদীগুলো খুলে দিয়ে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধিসহ প্রকৃতির ভারসাম্যতা ফেরানোর ব্যবস্থা করা হোক।

বৈশ্বিক আবহাওয়ার পরিবর্তন, বৈশ্বিক জলবায়ুর বিবর্তন এগুলোতো আমাদের হাতে নেই, আমরা স্থানীয়ভাবে যা পারি তা না করে অদৃষ্টবাদী হয়ে বসে থাকলে চলবেনা। একজন ধর্মভীরু হিসেবে এসতেসকার নামাজের উপর আপনার নির্ভরতা থাকুক, বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্যে রাষ্ট্র তার অবস্থান থেকে কাজ করুক। কিন্তু প্রাথমিকভাবে উপরোক্ত বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দিয়ে তড়িৎ ব্যবস্থা নিলে কিছুটা হলেও ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে মনে করি।

লেখকঃ
আনোয়ার হোসেন বাদল
কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

Tag:

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সেইভ করুন:

আমাদের সম্পর্কে জানুন:

South BD News 24

South BD News 24 is committed to publish the daily news of South Bengal based on authenticity, honesty and courage...

পটুয়াখালীতে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের কর্মবিরতি পালন, পরীক্ষা বন্ধ, অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন 

error: Content is protected !!

তাপদাহ – প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

আপডেট সময়: ০৩:৫০:২৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

চলছে গ্রীষ্মকাল। লক্ষণীয় যে, গত কয়েক বছর ধরে এ সময়ে তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলে। কিন্তু কেন বেড়ে চলে? আসুন একটুু হিসেব মেলানোর চেষ্টা করি।

নদীমাতৃক বাংলার দখিন জনপদে পটুয়াখালীর পায়রা নদীর তীরে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগেও এ জনপদে এতো পাকা সড়ক, দালানকোঠা কিংবা সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা গড়ে ওঠেনি। সড়কের দু’ধারে, অনাবাদী জমিতে প্রচুর গাছপালা ছিলো। সমুদ্র উপকূল এবং সুন্দরবন নিকটবর্তী হওয়ায় এ অঞ্চলকে ঘিরে ছিলো গভীর বনাঞ্চল, ছিলো অসংখ্য খাল-বিল, নদী-নালায় ভরপুর একটি জনপদ। ১৯৮০ সালে গঠিত হলো দুমকি উপজেলা। তখনও বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে পনেরো কিলোমিটার দূরে দুমকিতে গিয়ে কাজকর্ম সেরে আবার পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। তখনও দুমকিতে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়নি। তখনকার চীফ কেবিনেট সেক্রেটারী জনাব এম কেরামত আলী সাহেবের চেষ্টায় একটি কৃষি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কলেজটির ছাত্রাবাস ছিলো মাটির মেঝের উপরে গোল পাতার ছাউনীযুক্ত লম্বাকৃতির কাঁচা ঘর। তখনও আশে পাশে ২০/২৫ কিলোমিটারের মধ্যে আমাদের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিলো নৌকা অথবা পায়ে হাঁটা পথ। পটুয়াখালী জেলার যেদিকে তাকাতাম তখন দৃষ্টিনন্দন নদী, সবুজ অরণ্যে আর খাল-বিলে ভরা প্রকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি সমৃদ্ধশালী অঞ্চল।

প্রকৃতির সেই সৌন্দর্য হরণ এবং তদস্থলে ইট পাথরের নতুন নতুন স্থাপনার কাজটি তখন থেকেই শুরু হয়, ব্যাপকভাবে ঠিক আশির দশক থেকেই। যা, দ্রুত তরান্বিত হতে থাকে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দেশে নতুন গণতন্ত্রের আমলে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে নদীর পাড় দিয়ে বেড়িবাঁধ দিয়ে বিছিন্ন করা হয় নদী ও স্থলভাগকে, আটকে ফেলা হয় পানি চলাচলের সমস্ত খাল, ছোট ছোট শাখা নদী। উন্নয়নের নামে দেদারছে নিধন করা শুরু হয় সবুজ অরন্য, নদী ও খাল তীরবর্তী ম্যানগ্রোভ বৃক্ষরাজি। ধীরে ধীরে মরে যায় খাল, বিল, ডোবা নালা সব। নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে মেরে ফেলা হয় তার সদা চঞ্চল স্রোতধারা।

“এখানে রমণীগুলো নদীর মতো, নদীও নারীর মতো কথা কয়” আমাদের চোখের সামনে দেখতে দেখতে অপার সৌন্দর্যে ভরপুর লোহালিয়া, লাউকাঠি, কচাবুনিয়া, পাঙ্গাশিয়া নদীগুলো হারিয়ে ফেলে তাদের কুলকুল ধ্বনির সদা চঞ্চল স্রোতের বেগ। এখন নামে মাত্র ক্ষীণ স্রোতধারা লয়ে কোনমতে টিকে আছে এসব নদীগুলো। আরও দখিনে গেলে গলাচিপা’র ঐতিহাসিক নদী যেমন আগুনমুখা, রামনাবাদ, দাঁড়ছিঁড়া,কাজল, সবগুলো নদী ধীরে ধীরে যৌবন হারাতে থাকে। বিশাল বিশাল চর জেগে উঠেছে সেসব নদীবক্ষে। কলাপাড়ার আন্ধারমানিক, সোনাতলা, শিব বাড়িয়া নদী, আড়পাংগাশিয়া নদী, কচুপাত্রা ও ধানখালী এখন পুরোদস্তুর নাব্যসঙ্কটে ভুগছে।

পটুয়াখালীর প্রমত্তা পায়রা বর্ষাকালে তার দু’পাড়ের হাজার হাজার ঘরবাড়ি ফসলের ক্ষেত ভাসিয়ে দিতো। আবার শরৎ হেমন্তে যার রূপ মাধুর্যে আমরা বিস্মিত, বিমোহিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকতাম তাকে এখন উত্তর বঙ্গের হাওড়ের জলরাশির মতোই মনে হয়।

দেশে চলছে এক সপ্তাহের হিট অ্যালার্ট। অতিরিক্ত তাপদাহে গত তিনদিনে সারা দেশে অন্তত জনা সাতেক লোক মারা গেছেন। ক্রমেই বেড়ে চলেছে এই তাপদহন। দেশের গুটিকয়েক মানুষ যারা এসির মধ্যে বসে আছেন তারা হয়তো আমাদের মতো আম পাব্লিকের কষ্ট কোনমতেই বুঝবেন বলে মনে হয়না। তারা মানবেন কীনা জানিনা যে, তাদের দ্বারা অপরিকল্পিত নগরায়ন, যত্র তত্র অকার্যকর স্লুইস, কালভার্ট আর গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠা করা শত শত ইটের ভাটার কারণে মরু অঞ্চলে পরিণত হতে যাচ্ছে আমাদের সুজলা সুফলা সোনার বাংলা।

এতোক্ষণ বলেছি দখিনের কথা আর উত্তরের খবরতো দেশবাসীর কাছে আরও পরিস্কার। উজানের নদীগুলোর উপরে ভারতের একচেটিয়া দখল থাকার কারনে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে উল্লেখ করা বাহুল্যই বটে।

মনুষ্য সৃষ্ট এইসব কর্মযজ্ঞের কারনে দেশজুড়ে আজ দেখা দিয়েছে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা প্রভৃতি দুর্যোগ। গ্রামে গঞ্জে এখন আর দেশীয় মাছ নেই।
আম, জাম, তাল, নাড়িকেল, খেজুর গাছগুলো এখন অনেকটাই নিষ্ফলা। শহর গ্রামের টিউবওয়েলে পানির লেয়ার অনেক নিচে নেমে গেছে।

গত কয়েকবছর ধরে বলে আসছি, কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হোক, দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ইতিহাস হয়ে যাওয়া খাল আর শাখা নদীগুলো খুলে দিয়ে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধিসহ প্রকৃতির ভারসাম্যতা ফেরানোর ব্যবস্থা করা হোক।

বৈশ্বিক আবহাওয়ার পরিবর্তন, বৈশ্বিক জলবায়ুর বিবর্তন এগুলোতো আমাদের হাতে নেই, আমরা স্থানীয়ভাবে যা পারি তা না করে অদৃষ্টবাদী হয়ে বসে থাকলে চলবেনা। একজন ধর্মভীরু হিসেবে এসতেসকার নামাজের উপর আপনার নির্ভরতা থাকুক, বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্যে রাষ্ট্র তার অবস্থান থেকে কাজ করুক। কিন্তু প্রাথমিকভাবে উপরোক্ত বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দিয়ে তড়িৎ ব্যবস্থা নিলে কিছুটা হলেও ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে মনে করি।

লেখকঃ
আনোয়ার হোসেন বাদল
কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক